এর বিস্তারিত ব্যাখ্যায় যাবার আগে আসুন জেনে নিই ‘প্রশ্ন করা’ কী এবং ‘ভুল ধরা’ কী। আমেরিকায় আসার পর এ বিষয়গুলো আমার কাছে অনেক বেশী পরিস্কার হয়েছে। আমেরিকার গ্র্যাড স্কুল আপনাকে স্কলার/দার্শনিক বানাতে সহায়তা করবে মেশিন নয়। আর গ্র্যাড স্কুলগুলোর কাজ তো তাই-ই। আমাদেরকে বিভিন্ন ভাবে ভাবতে শেখাবে। বিভিন্ন প্রশ্নের উদ্রেক করাবে। কিন্তু আমরা, বিশেষ করে বাংলাদেশীরা প্রশ্ন করার চাইতে ভুল ধরাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি৷ এটাই আমাদের দেশী স্কুলিং।
আমার পছন্দের প্রফেসর বিওর্ন এর একটা ক্লাসের ফাইনাল প্রেজেন্টেশন এর কথা মন পড়লো৷ বিওর্ন সবাইকে বললো অন্যের প্রেজেন্টেশন এর কমেন্ট করতে। ‘কমেন্ট’ বলতে স্বভাবতই আমার মাথায় আসলো কিভাবে প্রেজেন্টারের ভুল বের করে চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করা যায়। পরে বিওর্ন কে জিজ্ঞেস করলাম, কী ধরণের কমেন্ট করতে পারি। সে বুঝিয়ে বললো যে, প্রেজেন্টেশনের ভালো দিকগুলো বের করে তাকে বলতে। কথাটা খুব সহজ শুনালেও আদতে এটাই সবচাইতে কঠিন কাজ। আমি বললাম, আমার দেশের শিক্ষকেরা তো প্রেজেন্টেশনের পর আমাদের অপমান করতো৷ বিভিন্ন ভুল বের করে শুধরাতে বলতো। এর উত্তরে বিওর্ন বললো, আমরা ওরকম করি না।
একটা সহজ উদাহরণ দিই। ধরুন আপনার পানির গ্লাসটা যেখানে থাকার কথা, ওখানে নেই; অন্য এক জায়গায় রাখা। আপনি আপনার ছোট ভাই/বোন-কে বললেন, “গ্লাসটা ওখানে রাখা কেন?” এই “কেন” জাতীয় প্রশ্ন করা মানেই ভুল ধরা এবং কৈফিয়ত জানতে চাওয়া। বিষয়টা বেশ সহজ মনে হলেও আসলে কিউমিলেটিভ ইম্প্যাক্ট অনেক বেশী। যেমন ধরুন আমাদের স্কুলিং এর কথা। ছোট বেলা থেকে জেনে এসেছি যে টিচাররা আছেই শুধু আমাদের ভুল ধরার জন্য। আমাদের আত্মবিশ্বাস কমতে কমতে একেবারে শূণ্যের কোঠায় চলে আসে৷ আমেরিকায় যদিও আসি, কিন্তু ঐ ভুল ধরা মানসিকতা পরিবর্তন করতে অনেকটা সময় লেগে যায়।
স্কুল-কলেজ-ভার্সিটিতে থাকতে আমি নিজে বিভিন্ন শিক্ষকদের দ্বারা এমন কতচাবে বুলিং এর শিকার হয়েছি তার হিসেব নেই৷ তখন মনে হতো শিক্ষকেরা তো এমনই হবে। কিন্তু ধীরে ধীরে যে নিজের আত্মবিশ্বাস ক্ষয় হয়েছে, তা বহুকাল পরে অনুধাবন করতে পেরেছি। দু:খের বিষয় হচ্ছে, বেশীরভাগ শিক্ষকরা জানেই না যে তারা কতবড় অন্যায় করেছেন।
যাই হোক, সত্যি কথা বলতে, আমাদের আসলে প্রশ্ন করতে পারার ট্রেনিং একদম নেই বললেই চলে৷ প্রশ্ন মানে গঠনমূলক প্রশ্ন। গ্র্যাড লাইফে গঠনমুলক প্রশ্ন করতে জানাটা অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ। আর গঠনমূলক প্রশ্ন করতে জানতে হলে দুটো কাজ করা উচিৎ। এক, লেকচার শুধু শুনেই ক্ষান্ত হওয়া না, বরং মাথার ভেতর এনালাইসিস করার সক্ষমতা বাড়ানো; এবং দুই, লেকচারের কোনো টপিককে পূর্ববর্তী কোনো টপিকের সাথে সংযুক্ত করানো।’
পড়াশোনা’ কথাটা কিভাবে এসেছে তা আমি বিস্তারিত জানি না। তবে এটা উপলব্ধি করতে পারি যে, আপনি যত বেশি পড়বেন, আপনি তত বেশি লিখতে পারবেন। একই সাথে, আপনি যতবেশি শুনবেন, আপনি তত বেশি বলার জন্য উপযুক্ত হবেন। তাই পড়া এবং শোনার উপরই জোড় দেয়া হয়েছে সবচাইতে বেশি। এক হাজারটা আর্টিকেল পড়ে হয়তো আপনি একটা আর্টিকেল লিখতে পারবেন, আবার এক হাজার মিনিট কারো বক্তব্য শুনলে হয়তো এক মিনিট আপনি কিছু বলতে পারবেন। আমাদের ট্রেইনিং টা হয় মূলত: উল্টো। আমরা না পড়েই লিখতে চাই এবং না শুনেই বলতে চাই। এতে করে যেটা আমরা অর্জন করতে পারি না সেটার মধ্যে অন্যতম হলো, একটা ভালো ইন্টারপার্সোনাল রিলেশন। আপনার পিয়ার-দের সাথে সম্পর্কে এই ইন্টারপার্সোনাল রিলেশন ভীষণ জরুরী। এবং গঠনমূলক প্রশ্ন করতে পারলে আপনি খুব সহজে এই স্পেসে ঢুকতে পারবেন।
ভুল ধরার মানসিকতা থেকে একেবারে বের হয়ে আসতে পারলে আপনি অনেকটা এগিয়ে যাবেন। কেউ ভুল করেও কোনো ভুল করে ফেললে তার ভুলটা প্রত্যক্ষভাবে না ধরিয়ে দেয়াটাই সমীচীন। আমি দেখি অনেক লোকাল আমেরিকান কিভাবে ছোট কোনো কাজকেও এপ্রেশিয়েট করে/ ভুলে ভরা প্রেজেন্টেশনের মধ্যেও অনুপ্রেরণার গল্প বলে, মোটিভেইট করে৷ তারা অন্যের কথা খুব মনোযোগ দিয়ে ধৈর্য্য ধরে শুনে। তারপর ফিডব্যাক দেয়৷ আমরা আমেরিকায় আসি, কিন্তু আমেরিকানদের এই ছোট ছোট ভালো ব্যাপারগুলো নিই না বা লক্ষ্য করি না। উচ্চশিক্ষা নিতে আসা মানে হচ্ছে আপনার জীবনে একটা বিরাট অভিজ্ঞতা নিতে আসা। এই অভিজ্ঞতা অর্জনের প্রতিটা সময়কে উপভোগ করতে পারলেই কেবল নিজের অনেক পরিবর্তন নিয়ে আসা সম্ভব। পুঁথিগত বিদ্যার পাশাপাশি আমি মনে করি এসব ব্যাপারে আমাদের অত্যধিক মনযোগী হতে হবে।
তাই প্রশ্ন করুন। গঠনমূলক প্রশ্ন করতে শিখুন। শুনুন। তারপর বলুন। পড়ুন। তারপর লিখুন।
#মোহাম্মদ আরফার রাজী
ফুলব্রাইট ফেলো
কমিউনিটি এন্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং
ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস এট অস্টিন।