আমাদের দেশের ইউনিভার্সিটি ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে একটি প্রচলিত বিশ্বাস আছে। ব্যাচেলর যে সাবজেক্টে সে পড়েছে, আজীবন সেই সাবজেক্টে আটকে গিয়েছে। ভবিষ্যতে হায়ার স্টাডিজে দেশের বাইরে গেলেও বুঝি সেই সাবজেক্টেই পড়তেই হবে। ভালো লাগুক বা না লাগুক। বেশ ডিপ্রেসিং একটা বিষয় আর এরকমই দেশে প্রচলিত। আমাদের দেশের মানুষগুলা খুব কিউট, ওদের চিন্তাধারা আরো কিউট!
মনে মনে ফিজিক্স-ম্যাথ অনেক পছন্দ করেন, ইচ্ছাও পড়ার। কিন্ত ভার্সিটিতে অনার্সে সাবজেক্ট পাওয়ার সময় ইঞ্জিনিয়ারিংই নেয়া লাগবে নাহলে আত্নীয় স্বজনরা কি বলবে। ডাক্তারি-ক্লিনিক্যাল ব্যাপার স্যাপারের চেয়ে গবেষণাধর্মী মলিকিউলার বায়োলজি ভালো লাগলেও আপনাকে ডাক্তারিই সিলেক্ট করতে হবে, নাহলে সবাই জাজ করবে। ভাগ্যক্রমে আপনি কোন শেষের সারির সাবজেক্ট পাইছেন, আর তাহলে কথাই নাই, আত্নীয় স্বজনদের ভবিষ্যৎবাণীতে আপনার ক্যারিয়ার ওখানেই শেষ। আর আপনিও ডিপ্রেসড হয়ে ভাবছেন এর থেকে বের হতে পারবেন না।
সাবজেক্ট চয়েসে ম্যাথ পাইছেন, কিন্ত স্বপ্ন ছিল কম্পিউটার সায়েন্স পড়বেন। কোন সমস্যা নাই, দেশের বাইরে ঠিকই কিন্ত মাস্টার্সে কম্পিউটার সায়েন্স পড়তে পারবেন ম্যাথের অনার্স দিয়ে। আর আমাদের এই কিউট দেশে সেটা করতে গেলে অনেক অযাচিত প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন। ম্যাথে অনার্স করে কম্পিউটার সায়েন্স ডিপার্টমেন্টে এপ্লাই করতে পারবেন না – হেনতেন হাবিজাবি সব রুলস। অথচ ম্যাথ আর থিওরিটিক্যাল কম্পিউটার সায়েন্স দুই যমজ ভাইয়ের মত! এগুলা বেশিরভাগই কেউ বুঝায়ে বলে না আমাদের ছেলেপেলেদের।
কেমিস্ট্রি পেয়ে খুব হতাশ লাগে, যে বন্ধুরা কত কুল সাবজেক্টে পড়ে। অথচ কেমিস্ট্রি পড়ে, দেশের বাইরে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং সহ ন্যানোটেকনোলজিতে মাস্টার্স/পিএইচডি করতে পারবেন – ন্যানো সাইজের কেমিক্যাল রোবোটিক্স ফিল্ডে কাজ করতে পারবেন- সেগুলা পুরা সায়েন্স ফিকশনের মত উচ্চ-মার্গীয় রিসার্চ, অথচ কেমিস্ট্রিতে পড়া ছেলেটা কত হতাশ হয়ে ঘুরে কারণ তাকে এভাবে কেউ বুঝায়ে বলে নাই। ফিজিক্সে পড়ে কত শত পাব্লিক মাস্টার্স-পিএইচডি ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে করে আমেরিকায় কানাডায় প্রফেসর হয়ে গেছে। ভেটেরিনারি সায়েন্স পড়ছেন, ভাবছেন সারাজীবন গরুর ডাক্তার এমন ট্যাগ লেগে গেলো। দেশের বাইরে বায়োটেকনোলজিতে মাস্টার্স করতে চলে আসেন। কেউ আপনাকে জাজ করবে না। এগ্রিকালচারাল সায়েন্স পড়ছেন, তো কি হয়েছে, এমন অনেককেই চিনি এখন পিএইচডি করতেছে ক্যান্সার বায়োলজিতে। এসব যদি আমাদের ছেলে পেলেদেরকে দেশের ভার্সিটির স্যারেরা একটু কাউন্সেলিং করে বলতো, অনেকের মনের হতাশা দূর হয়ে যেত।
আমেরিকা ও কানাডায় কেউ সরাসরি স্কুল-কলেজের গন্ডি পেরিয়ে ডাক্তারি বা আইন পড়তে পারে না, যেমনটা আমাদের দেশে হয়। মানে কেউ দ্বাদশ শ্রেণীর চৌকাঠ পার করেই সরাসরি কোনো মেডিকেল বা ল’ স্কুলে ব্যাচেলর করতে পারে না। ডাক্তারি বা ল’ পড়তে গেলে তাকে আগে একটা ভার্সিটি থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রি করতে হবে, সেটা যেকোন বিষয়েই হোক। ইতিহাসে ব্যাচেলর করে কেউ ডাক্তারি পড়ে , কেউ বায়োলজিতে অনার্স করে ডাক্তারি পড়ে, কেউ ইকোনোমিক্সে অনার্স করে ডাক্তারি পড়ে , কেউ ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ল’ স্কুলে পড়তে যায়। এজন্য আমেরিকা ও কানাডার ডাক্তার ও ল’ইয়ার দের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করলে সায়েন্স, বিজনেস, আর্টস, ইঞ্জিনিয়ারিং সব ধরণের ব্যাকগ্রাউন্ডই পাবেন। আমার পিএইচডি গবেষণার বিষয়টি আমেরিকাতে পেটেন্ট আকারে ফাইল করি। তখন পেটেন্ট ফাইলিং এর সময়ে আমেরিকান ল’ইয়ারের সাথে অনেক মিটিং করার অভিজ্ঞতা হয়। সেই ল’ইয়ারও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছিল ব্যাচেলরে। এরপর ল’ পড়ে এখন পুরোদস্তর ল’ইয়ার হিসেবে প্রাকটিস করে।
গ্রাজুয়েট স্কুলে রিসার্চ ইন্টারেস্ট চেইঞ্জ হওয়া খুবই কমন বিষয়। এতে এতটা চিন্তিত হবার কিছুই নেই। দেশের বাইরে সকল একাডেমিশিয়ান ও প্রফেসররা এই পরিবর্তনকে পজিটিভলিই নেন। ধরুন আপনি আন্ডারগ্রেডে একটা টপিক নিয়ে থিসিস করছেন, রিসার্চ পেপারও আছে। কিন্ত আপনি অন্য টপিকে পরবর্তীতে ইন্টারেস্টেড ফিল করছেন, এবং মাস্টার্স/পিএইচডি সেই টপিকে করার ইচ্ছা হচ্ছে। তাহলে গ্রাজুয়েট এডমিশন কমিটির জন্য সুন্দর করে একটা SOP (স্টেটমেন্ট অব পারপাস) রেডি করতে হবে এবং কনভিন্স করতে হবে যে আপনি আসলেই এই টপিকের উপর ইন্টারেস্টেড। এঁরা সবাই ঝানু। হাজারো স্টুডেন্ট চড়ায়ে প্রফেসররা চুল পাকিয়েছে। জেনুইন ইন্টারেস্ট হলে ঠিকই সেন্স করবে আর একসেপ্ট করবে। দেশের বাইরে আজকাল পটেনশিয়াল রিসার্চ ফিল্ড গুলা মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি- মানে পাঁচ-মিশালী। এডভান্সড টপিক গুলা নিয়ে যে রিসার্চগুলো হয় দেশের বাইরে সেইসব টিমে বায়োলজিস্ট, ইঞ্জিনিয়ার, ম্যাথমেটিশিয়ানরা এক সাথে কাজ করে।
ছাত্রদের কথা বাদ দিলাম, ইভেন প্রফেসরদের নিজেদের ক্যারিয়ারেই তারা অনেক নিউ ফিল্ড যেগুলা নিয়ে সে আগে কাজ করে নাই, সেগুলার দিকেও তাদের রিসার্চ শিফট হয় ফান্ডিং ও কোলাবরেশনের জন্য। যেমন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর অনেক প্রফেসর আজকাল মেশিন লার্নিং এর দিকে ঝুকছে, ইলেক্ট্রনিক্স এর অনেক প্রফেসর আজকাল বায়ো-সেন্সরের দিকে ঝুকছে। তাই গ্রাজুয়েট স্কুলে রিসার্চ ইন্টারেস্ট চেইঞ্জ হওয়া খুবই খুবই কমন ঘটনা। সেটা শুধু ছাত্রদের জন্যই নয়, বরং প্রফেসরদের জন্যেও বটে।
দুর্ভাগ্যক্রমে (!) দেশের বাইরে শিক্ষাকে সবাই সীমাহীন, লাগামহীন হিসেবে বিবেচনা করে। যে কেউ চাইলে একাডেমিক ক্যারিয়ারের যেকোন সময়ে সাবজেক্ট/ রিসার্চ ইন্টারেস্ট চেইঞ্জ করতে চাইলে করতে পারে। মাস্টার্স বা পিএইচডিতে ব্যাচেলরের সাবজেক্ট ব্যতীত অন্য যেকোন বিষয় উপযুক্ত প্রি-রিকুইজিট সাপেক্ষে চাইলে পড়তে পারে। এতে কেউ জাজ করতে আসবে না।
© Md Nazmul Hasan Topu, UBC, Canada