অ্যাডমিশন সিজনে অনেক স্টুডেন্টের পোস্ট দেখা যায় নানান হতাশা নিয়ে – খারাপ সিজি তাই অ্যাপ্লাই করতে পারছি না, টাকাপয়সার সমস্যা তাই পুরো অ্যাপ্লিকেশনের জন্য যে টাকা দরকার সেটা যোগাড় করতে পারছি না, স্টাডি গ্যাপ পড়ে গেছে, বয়স হয়ে গেছে, জবে আটকে গেছি ইত্যাদি, তাই হায়ার স্টাডিতে যেতে পারবো কিনা এই নিয়ে সন্দিহান ইত্যাদি। এই সমস্যাগুলো সমাধান করে এগোনোর উপায় কী?
এবার একটা ৬-স্টেপ চিন্তার মধ্য দিয়ে যানঃ
১। ৬ মাস থেকে ১ বছরের জন্য একটা প্ল্যান করুন। মেনে নিন যে হায়ার স্টাডিতে যাওয়ার জন্য ওভারনাইট কোন সলিউশন নেই। আজকে আমার বন্ধু প্লেনে উঠে বসেছে, তাই আমারও বসতে হবে, এই চিন্তা বাদ। এই ছয় মাস থেকে এক বছর কী করবেন? আগে বের করবেন যে কেন হায়ার স্টাডিতে যেতে চান, কেমন প্রোগ্রামে যেতে চান, এই প্রোগ্রামগুলো কোথায় আছে খুঁজে বের করার জন্য, এবং সেজন্য যদি কোন অ্যাকাডেমিক বা টেকনিক্যাল স্কিলসেট লাগে, সেটা শেখার জন্য। অর্থাৎ আপনার যে কমতিগুলো আছে, সেগুলো পোষানোর জন্য কাজ করবেন। এছাড়াও মিনিমাইজ করবেন টক্সিক সোশ্যাল নেটওয়ার্ক (যেমন আত্মীয়স্বজন যে বাঁকা কথা শোনাচ্ছে, বন্ধুবান্ধব যারা শুধু চিল করতে বলে, অর্থাৎ আপনার গোল থেকে সরিয়ে দেয় বা সময় নষ্ট করে বা সেলফ এস্টিম কমিয়ে দেয় এসব)। প্ল্যানের দুটো অংশ রাখবেন, একটা অ্যাকাডেমিক এবং একটা ফিন্যানশাল। অর্থাৎ কেমন প্রোগ্রামে যাবেন, এবং সেখানে যাওয়ার জন্য টাকা কীভাবে যোগাড় করবেন।
২। আপনার সবল জায়গা আর দুর্বল জায়গাগুলো খুঁজে বের করুন এবং এগুলো নিয়ে কাজ করুন (সবলতাঃ দ্রুত শিখতে পারেন কিনা, আগ্রহ আছে কিনা, আগ্রহ থাকলেও রিপিটেটিভ প্রবলেম সলভিং কিংবা লং আওয়ার টেকনিক্যাল প্রবলেম সলভিং পারেন কিনা, টেকনিক্যাল কাজের লং টার্ম ইম্প্যাক্ট বোঝেন কিনা ইত্যাদি। দুর্বলতাঃ কম অ্যাটেনশন স্প্যান, স্টাডি গ্যাপ, বয়স, টাকাপয়সার অবস্থা, ফ্যামিলি প্রবলেম, স্বাস্থ্য ইত্যাদি)।
৩। প্রতিদিন একটা “আফটার আওয়ার রুটিন” সেট করুন ১-২ ঘণ্টার জন্য, যে সময়ে আপনি দুনিয়া উলটে গেলেও কাজ করবেন আপনার স্কিলসেট ডেভেলপ করার জন্য। এটা ২ ঘণ্টা না ১০ ঘণ্টা তা ব্যাপার না, কিন্তু প্রতিদিন করবেন এটা নিশ্চিত করতে হবে। কাজিনের বিয়ে, গা ম্যাজম্যাজ, অমুক বন্ধুর ফোন এসেছে – এই জাতীয় এক্সকিউজ বাদ দিয়ে হলেও প্রতিদিন কাজ করতে হবে।
৪। এই আফটার আওয়ার সময়ে আপনি আপনার এরিয়ার যে স্কিলগুলোতে পিছিয়ে আছেন, সেগুলো শিখবেন, ভার্সিটি শর্টলিস্ট করবেন, অ্যাক্টিভ প্রোফেসর খুঁজবেন, ল্যাব ওয়েবসাইট এক্সপ্লোর করবেন, কাগজপত্র রেডি করবেন ইত্যাদি। শেখার জন্য ইউটিউব ইউডেমি কোর্সেরা সব আছে। ভার্সিটি আর প্রোফেসর খোঁজার জন্য লিংকডইন আছে, হায়ার স্টাডি গ্রুপগুলোতে অ্যাকসেপ্টেন্স লিস্ট আছে, অনেকের অ্যাকসেপ্টেন্স এবং রিজেকশন পোস্ট আছে। সবখানে লিংক বা পাঁচ মিনিটের ভিডিও খুঁজবেন না, আপনি ধরেই নেবেন যে একদিনে খুঁজে বার করা সম্ভব না। আস্তে আস্তে সময় নিয়ে করবেন। যা শিখছেন বা খুঁজছেন বা খুঁজে পাচ্ছেন – সবকিছুর নোট নেবেন – কাগজে বা স্প্রেডশীটে।
৫। এই কাজগুলোর বাইরে প্রতিদিন শুধু ভাবার জন্য কয়েক মিনিট সময় রাখবেন। অনেক সময় আমরা অবসেসড হয়ে যাই হায়ার স্টাডির জন্য, কিন্তু হতে পারে আপনার জন্য দেশে ভালো অপশন আছে, কিংবা আপনার হয়তো এখন যাওয়ার বদলে এক বছর পরে গেলে ভালো, কিংবা আপনি হয়তো বিদেশের চ্যালেঞ্জ নিয়ে ভালোমত ইনফরমেশন এখনো নেন নি। এই ইনফরমেশনগুলো নেবেন এবং সেগুলো নিয়ে ভাববেন যে এটা আপনার পোষাবে কিনা। সবার সবকিছু পোষানোর দরকার নেই। যেকোনো প্রোগ্রামে শুধু কীভাবে ঢুকতে হয় সেটা নিয়ে ভাববেন না, ভাববেন এই প্রোগ্রামের অ্যাকাডেমিক চ্যালেঞ্জ কী, টাইমলাইন কী, ক্যারিয়ার অপশন কী ইত্যাদি। অর্থাৎ, প্রত্যেক ট্র্যাকের শুধু ইনকাম না দেখে চ্যালেঞ্জ এবং টাইমলাইন দেখবেন।
৬। এইসব করতে করতে আপনি কয়েক মাসের মধ্যে হয়তো কিছু রাস্তা দেখতে পাবেন। কিছু ফুল ফান্ডেড রাস্তা, কিছু পার্শিয়াল ফান্ডেড, কিছু সেলফ ফান্ডেড। যেকোনো রাস্তা দেখলেই সব ছেড়েছুঁড়ে দেবেন না, বরং সেই রাস্তাটাকে জাজ করবেন যে আপনার জন্য এই রাস্তা ভালো কিনা। অন্য বাস্তব প্যারামিটারগুলো মাথায় রাখবেন, যেমন বায়োলজিক্যাল ক্লক, ফ্যামিলি রেসপনসিবিলিটি, বিয়ে, সন্তান (যদি থাকে) ইত্যাদি। এটা সহজ হবে যখন কোন ডিসিশন মেকিং এর সময় আপনি Pros and Cons লিখে লিখে করবেন, তখন সবকিছু চোখের সামনে দেখতে পাবেন।
টেকনিক্যাল পার্ট শেষ, এবার কিছু তিক্ত নন-টেকনিক্যাল পার্ট নিয়ে কথা বলি। যেহেতু অনেক স্টুডেন্টের সাথে হায়ার স্টাডি নিয়ে কথা বলার অভিজ্ঞতা হয়েছে, কাজেই আমি মনে করি যে এই পয়েন্টগুলো সব স্টুডেন্টের মাথায় রাখা উচিৎঃ
১। প্রত্যেক ট্র্যাকে কিছু ব্যারিয়ার থাকে, যেটাকে ক্রস করতে হয়। এটা সম্ভব না যে আপনি একটা ডিফিকাল্ট ট্র্যাকে হাঁটবেন আবার পুরো সময়টা গুড ফিলও করবেন। অর্থাৎ, যেকোনো সিগনিফিক্যান্ট মাইলস্টোন স্পর্শ করতে হলে আপনার কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা, বিরক্তি, রাগ, হতাশা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
২। আমি নিজেকে চেঞ্জ করবো না, কিন্তু আমার প্রবলেম সলভ হয়ে যাবে সামহাও, এটা কখনো হবে না। কোন না কোন অ্যাক্টিভ স্টেপ নিতেই হবে।
৩। আমার যেটা স্বপ্ন, বা আমি যেটা করতে চাই, বা আমার যেটা ভালো লাগে – সেটাই যে আমার জন্য ভালো, এমন কোন কথা নেই। হতে পারে আপনার জন্য সবচেয়ে বিরক্তিকর, সেটা আপনার জন্য সবচেয়ে ভালো ক্যারিয়ার চয়েজ। স্বপ্ন দেখো, তুমি পারবেই – এসব বাজারি কথা, মোটিভেশনাল স্পিকাররা ব্যবহার করে থাকেন অল্প সময় উত্তেজনা সৃষ্টি করার জন্য। এগুলোকে সবসময় এত গুরুত্ব দেয়ার কিছু নেই।
৪। অনেক স্টুডেন্টের একটা ভুল অ্যাপ্রোচ হচ্ছে সবখানে মোটিভেশন খোঁজা। মোটিভেশন অল্পস্বল্প খুঁজবেন, বেশি খুঁজবেন স্ট্র্যাটেজি – কারণ দ্বিতীয়টাই দরকার।
৫। অনেক স্টুডেন্টের সাথে ডিল করে আমার উপলব্ধি হচ্ছে এই যে, বাংলাদেশের গড়পড়তা একটা স্টুডেন্টের সমস্যা হচ্ছে “ভাল্লাগেনা সিনড্রোম”। আমার ভাবতে ভাল্লাগে না, আমার কিছু অ্যাকটিভলি করতে ভাল্লাগে না, নিজেকে নিয়ে প্রশ্ন করতে ভাল্লাগে না, আমার রুটিন মানতে ভাল্লাগে না ইত্যাদি। ফলশ্রুতিতে অনেকেই অ্যাকাডেমিকলি সাফার করে, ডিপ্রেশনে ভোগে, কিন্তু কারণটা জানে না। কারণটা খুব সহজ – আমাদের শুধু এন্টারটেইনমেন্ট বা চিল করতে ভালো লাগে। এই তারাই আবার পরের কোন ক্রুশাল স্টেজে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, সবই তো করলাম, কিন্তু পিছিয়ে কেন?
৬। আমরা খুবই একটা চ্যালেঞ্জিং টাইমের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে জাস্ট চিল করে পার করলে হবে না, অন্তত বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত একটা ছেলে/মেয়ে যদি কোন পারপাস, প্ল্যান ইত্যাদি ছাড়া এগোয়, খুবই বড় সম্ভাবনা যে তারা দশ-পনেরো বছর পরে তারা উপলব্ধি করবে যে তারা গ্লোবালি অনেক পিছিয়ে গেছে। তখন আর উপলব্ধি করে লাভ নেই, যখন ফোকাসড এবং প্ল্যানড হলে লাভ আছে, তখুনি হওয়া উচিৎ। মধ্যবিত্ত এবং এভারেজ স্টুডেন্টদের জন্য রাস্তা তৈরি করা থাকে না, কাজেই একটু বেশি এফোর্ট দিতে হয় – সেটা তো বলেছিই।
সবার জন্য শুভকামনা। আশা করি কাজে আসবে।
©️ইসহাক খান
অ্যারিজোনা
Edited by
Tanjila Akther
Campus ambassador
National University Research and Higher Study Association