EducationHigher Study Preparation

লো সিজিপিএ ধারীরা আমেরিকায় কীভাবে আসবেন

——–

গ্রুপে অনেক প্রশ্ন আসে এরকম যে, তাদের সিজিপিএ অনেক খারাপ৷ কিভাবে নিজেকে সমৃদ্ধ করা যায় এবং আমেরিকার কোনো ভার্সিটিতে কিভাবে এডমিশন নেয়া যায় ইত্যাদি। এ ধরনের প্রশ্নের কোনো সোজা-সরল উত্তর নেই। যেমনটির কোনো উত্তর নেই হাই সিজিপিএ ধারীদের ক্ষেত্রেও। যাদের ভালো সিজিপিএ তারা যেমন নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে আমেরিকান ইকোনোমিতে ঢুকতে পারবে না, তেমনি লো সিজিপিএ ধারীরা এমন চিন্তা কখনো করবে না যে কখনো তারা আমেরিকায় আসতে পারবে না। তাহলে পুরো বিষয়টা কী?

প্রথমেই বুঝতে হবে যে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সবার জন্যই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করেই রাখে। বাংলাদেশের মতন না যে, সিজিপিএ খারাপ মানে সে অচ্ছ্যুত। সিজিপিএ শর্টলিস্ট করার ক্ষেত্রে কাজে লাগে। এইটুকুই৷ তারপরও সব ভার্সিটির জন্য না৷ টপ কিছু ভার্সিটি এরকম ডিমান্ড করে। তবে, আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং আশেপাশের অনেকের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, এসব খুব ফ্লেক্সিবল। আপনি যদি নিজেকে ঐ মার্কেটে একজন এসেট হিসেবে প্রকাশ করতে পারেন, তাহলে এসব সিজিপিএ কোনো ব্যাপার না। বিশ্ববিদ্যালয় বাছাই করা এবং পটেনশিয়াল প্রফেসরের সাথে কানেক্ট করতে পারাটা একটা অসীম ধৈর্যের কাজ। এখানে যদি নিজেকে আপনি ফিট করাতে পারেন, তাহলে আমি এডমিশন না হওয়ার কোনো কারণ দেখি না।

এবার দুটা উদাহরণ দিই। আমার নিজের ক্ষেত্রে আমি দুইটা ভিন্ন ভার্সিটির দুইজন প্রফেসরকে ম্যানেজ করেছিলাম আমার সিভি দিয়ে, যেখানে আমার সিজিপিএ উল্লেখই ছিলো না। এখনো আমার সিভিতে সিজিপিএ উল্লেখ নেই। ঐ দুইটা উচ্চ র‍্যাংকের গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ফান্ডিং কনফার্ম করে ফেলেছিলাম সিজিপিএ না দেখিয়েই। হ্যাঁ, আমাকে তো পরে ট্রান্সক্রিপ্ট পাঠাতে হয়েছিলো এডমিশন এর জন্য। কিন্তু এডমিশনের আগেই আমি ফান্ডিং কনফার্ম করে রেখেছিলাম। কেন দিই নি সিজিপিএ? এর উত্তর আমার কাছে সরল। দেখানোর মত সিজিপিএ আমার ছিলো না। এখন দেখি অনেকের সিজিপিএ ৪ বা ৩.৯ বা ৩.৮। আর আমার ক্ষেত্রে এটা ছিলো ৩.৫ এর আশেপাশে। এটা উল্লেখ করার মত কিছু ছিলো না। তাই করি নি। বরং আমার কাছে মনে হয়েছিলো এটা দেখে আমার প্রোফাইল সম্পর্কে আবার কেউ জাজমেন্টাল হয়ে যায় কি না, তাই।

দ্বিতীয় উদাহরণ হলো আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে আমার রুমমেটের সাফল্য। তার সিজিপিএ খুব সম্ভবত ২.৯ বা এর আশেপাশে ছিলো। এখন সে জন্স হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বিরাট গবেষক। আমি দেখেছি, সে কি রকম অমানুষিক পরিশ্রম করেছে সেই সময়। সফলতা এমনি এমনি আপনার হাতে চলে আসে না। জীবনে শর্টকাট বলতে কিছু নেই।

এবার আসি মূল আলোচনায়। আপনার সিজিপিএ লো, এটা কিন্তু কোনোভাবেই আপনি সরলীকরণ করে নিজের পক্ষে সাফাই গেয়ে ভুল সংশোধন করতে পারবেন না। এটা মেনে নিতেই হবে যে আপনার খামখেয়ালি ছিলো। পড়াশুনা করেন নাই। যেটা আমিও মেনে নিয়েছিলাম। জিপিএ ফার্স্ট ব্যাচ/ অসুস্থ ছিলাম/ মেনটাল ব্রেকডাউন হয়েছিলো- ইত্যাদি কোনো ভাবেই আপনি কারণ দর্শাতে পারবেন না। নিজের খামখেয়ালীপনা এবং উদাসীনতা মেনে নিলে নিজের জন্যই ভালো৷ এখন, ঐ যে বলালাম, শর্টকাট কোনো রাস্তা নেই। তাই যা ভুল করেছেন, তা থেকে শিক্ষা নিয়ে আপনার পরিশ্রমের মাত্রা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিন। সোজা কথা হচ্ছে, “যে পরিশ্রম টা আপনাকে করতে হতো, ঐ কোটা আপনাকে কোনো না কোনো ভাবে পূরণ করতেই হবে”। হয়তো রিসার্চ প্রোফাইল এনরিচ করবেন বা জিআরই/ টোয়েফেল স্কোরের দিক থেকে এনরিচড থাকবেন- যেভাবেই হোক, আপনার গ্যাপ ফিলাপ করতে হবে।

গ্যাপ ফিলাপ কিভাবে করবেন? শুরুতে নিজে নিজেকে প্রশ্ন করুন, আমেরিকায় কেন আসতে চান? দেশে চাকুরি নাই/ দেশের পরিস্থিতি ভালো না/ ভবিষ্যৎ নাই/ আমেরিকান সিটিজেন হবেন/ ভালো গবেষক হতে চান- কারণ যাই হোক না কেন, আপনি আসতে চান। বলার অপেক্ষা রাখে না, এখানে আপনার আয় রোজগার এবং জীবন ব্যবস্থা অনেক অনেক উন্নত, যদিও হাজারটা সমস্যা রয়েছে। কিন্তু এই উন্নত জীবন ব্যবস্থা অনেকে গ্রহণ করতে পারে না। দেশে থাকতেই আপনাকে অনেক ওপেন মানসিকতার হতে হবে। নিজের প্রতি সৎ থাকতে হবে। নিজের প্রতি নিজের কমিটমেন্ট ঠিক রাখতে হবে। এগুলা বেসিক জিনিস। এগুলো ঠিক না করলে পরের স্টেপগুলো নিতে পারবেন না। কারন এসবই একই সুঁতায় গাঁথা।

যেহেতু সিজিপিএ আপনার খারাপ, আপনি নিজেকে একটু সময় নিয়ে গোছান। এখানে কিছু কাজের লিস্ট দিলাম, যেভাবে নিজেকে ডেভেলপ করতে পারবেন।

(১) কমিউনিটি প্রোগ্রাম এবং ভলান্টিয়ার কার্যক্রম

আপনি চাকুরি করেন বা ছাত্র, যাই করেন না কেন, সপ্তাহে একটা ভলান্টিয়ার কাজ করুন। এটা আপনাকে বহুমাত্রিক একটা আইডিওলজিক্যাল শেইপ দিবে। এবং এই কাজটাকে প্রকাশ করতেও জানতে হবে। যেমন, আমি আমার পাড়ার একটা স্কুলের বাচ্চাদের কে দুই বছরের মতন গুগলে কিভাবে সার্চ করবে, কিভাবে বিভিন্ন প্রোডাক্ট অনলাইনে অর্ডার করবে ইত্যাদি নিয়ে সপ্তাহে একদিন এক ঘন্টা করে ক্লাস নিতাম। এই কাজটা একেবারে নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে করতাম। এবং এটা আমি আমার সিভিতেও উল্লখ করেছিলাম এবং এখনো করি। এক ইন্টারভিও তে এক প্রফেসর এই বিষয়ে আমাকে অনেক আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো। এবং ঐটাতে আমি সফলও হই। আমার কাছে মনে হয়, এই কাজটা আমার সিভি এবং এসওপি কে কিছুটা হলেও সমৃদ্ধ করেছে।

(২) পেপার পাবলিকেশন

যেহেতু আপনার সিজিপিএ খারাপ, তাই এই ব্যাপারটা নিয়ে কাজ করতে পারেন। কোনো না কোনো বড় ভাই/ বন্ধু/ ছোট ভাই আপনার আছে, যারা ভালো পাবলিকেশনের কাজ করে বা গবেষণা করে। তাদের সাথে যোগাযোগ করুন। নিজের ইগো-কে এক পাশে রেখে তাদের সাথে কাজ করতে শিখুন। যেহেতু সারাজীবন পড়াশুনা করেন নাই, তাই এটা আশা করা বোকামী হবে যে আপনি নিজে নিজে একটা পেপার পাবলিশ করে ফেলবেন। গাইডেড/ সুপারভাইজড রিসার্চ আপনাকে সমৃদ্ধ করবে। দরকার হলে তাদের এভাবে বলুন, “আমাকে তোর সাথে রাখ। কাজ/ এনালাইসিস এগুলা আমি করবো৷ কাজটা আমি শিখবো”। এভাবে আপনি একটা পেপার লেখায় কোলাবোরেট করতে পারবেন। একটা কো-অথরড পেপার আপনার হয়ে যাবে।

(৩) পটেনশিয়াল নেটওয়ার্ক

আপনি যে সাবজেক্টের, সেই সাবজেক্টের অন্তত একজন ভালো গবেষকের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করুন। দুই একটা পেপারের কাজ করতে গেলেই টের পাবেন কারা এই ফিল্ডে ভালো। এ যুগে কাউকে খুঁজে পাওয়াটা খুব কঠিন কিছু না। খুঁজে পেলেও খালি হাতে তাদের কাছে গিয়ে লাভ নেই। মেসেঞ্জারের আননোন ম্যাসেজ আসে এরকম, “হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম”। এর পর আর কোনো লাইন নেই৷ এখানে সবাই আননোন কারো সালামের উত্তর দিতে বাধ্য না। সেরকম ভাবেই কাউকে রিচ করতে গেলে তাকে পুরো ম্যাসেজটা ভালোভাবে বলতে হবে। সে যাতে আগ্রহী হয়, সেরকম ভাবেই তাকে এপ্রোচ করতে হবে। এটা ইমেইলে করলেই ভালো। এ ধরনের কারো সাথে কোনো একটা পেপার/ গবেষণায় যুক্ত হবার চেষ্টা করুন। এটা আপনার ভবিষ্যৎ রেকমেন্ডেশনে কাজে লাগবে।

(৪) একটা ভালো এসওপি

এসওপি লিখুন। জীবনের সব ভালো-মন্দ ঘটনা মনে করে একটা ড্রাফট লিখুন শুরুতে। পেইজ লিমিট ভাবা লাগবে না। একটা ড্রাফট দাঁড় হয়ে গেলে এরপর ঘষামাজা করবেন বছরের পর বছর। আমার প্রথম এসওপি ছিলো ১২ পৃষ্ঠার। সব লিখেছিলাম। তারপর কাটতে কাটতে ২/৩ পেইজে নিয়ে আসি। অনেককে দিয়ে রিভিও করিয়েছিলাম। এখনো প্রতিনিয়ত আপডেট করছি।

(৫) জিআরই এবং টোয়েফেল

যেহেতু রেজাল্ট খারাপ, আর আপনার ভার্সিটি যেটা রিকোয়ার করবে, সেই স্কোর অর্জন করার জন্য জীবন বাজি রেখে এফোর্ট দিন। এগুলা মিনিমাম। করতেই হবে। আগের গ্যাপ ফিলার আর কী!

(৬) একটা ভালো সিভি

সিভি বানান। সিভি আপডেট করুন। বিভিন্ন সিভি ঘাটুন। সিভি এবং এসওপি এর মধ্যে সামঞ্জস্য রাখুন। এসওপিতে উল্লেখ করতে পারেন নি, এমন কিছু সিভিতে প্রেজেন্ট করুন এবং ভাইস-ভার্সা। বিভিন্ন প্রফেসরের সিভি অনলাইনে পাওয়া যায়, দেখুন একটা পূর্ণ একাডেমিক/ রিসার্চ সিভিতে কী কী থাকে।

(৭) লিখিত ভাষা দক্ষতা বৃদ্ধি

রাইটিং স্কিল অবহেলিত রাখবেন, জীবনে পদে পদে ধরা খাবেন। হাবিজাবি যা মাথায় আসে, লিখুন। হয় বাঙলায় বা ইংরেজিতে। লেখা হচ্ছে যোগাযোগের উতকৃষ্টতম মাধ্যম। এ ব্যাপারে নজর দিন। যেহেতু আমেরিকায় আসতে চান, ইংরেজিতে লেখার অভ্যাস করুন।

(৮) একটা ভালো এক্সেল শিট/ স্প্রেডশিট

এইটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটা মাস্টার এক্সেল ফাইল বানান। এক এক শিটে এক এক কন্টেন্ট থাকবে৷ যেমন, প্রথম শিটে আপনার টার্গেটেড বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটা তালিকা, তারপর প্রফেসরদের তালিকা, এডমিশন রিকোয়ারমেন্ট, আর্টিকেলের তালিকা ইত্যাদি। এটা যখন শুরু করবেন তখন হয়তো কিছু থাকবে না, কিন্তু এক বছর পরে আপনি হয়ে যাবেন “দ্য মোস্ট রিসোর্স্ফুল লো সিজিপিএ পার্সন”

(৯) অন্যকে সাহায্য করার মানসিকতা

অন্যকে হেল্প করুন। এটা আপনার মোরাল কম্পাসকে শক্তিশালী করবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা করবে, সেটা হচ্ছে আপনি নিজে নিজেকে হেল্প করছেন। এই যেমন, এই বড় পোস্টটা লিখছি, আসলে নিজের জন্যই লিখছি। নিজে অনেক কিছু জানতে পারবো বলে আশা রাখি। আমার চিন্তা করতে হচ্ছে, ব্রেইনটাকেও এক্টিভ রাখছি ইত্যাদি।

(১০) প্রচুর পড়া

এই পয়েন্টটা সবার শেষে লিখলেও এটাই হয়তো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হতে পারে। প্রচুর পড়বেন। ভালো কন্টেন্ট পড়লে নিজেরা সমৃদ্ধশালী হবেন। ঐ যে নেটওয়ার্ক এর কথা বললাম, সেটা অনেক বেগবান করতে পারবেন।

শেষ কথা হলো সেই শুরুর কথাটাই৷ আমেরিকা আপনার সাথে ফেয়ার প্লে করবে। কিন্তু নিজেকে আপনার ডেভেলপ করতে হবে। সিজিপিএ খারাপ হয়েছে, এটাকে রিকোভার করতে হলে বেশ অনেকভাবে আপনাকে এনরিচড হতে হবে। প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে যাদের হাই জিপিএ তাদের তুলনায়। লাইফ ইজ নট এ বেড অফ রোজেস।

শুভকামনা।

লিখতে লিখতে আরো অনেক কথা মাথায় আসছিলো, কিন্তু এই পোস্ট অলরেডি অনেক বড় হয়ে গেছে। স্পেসিফিক টপিক নিয়ে পরবর্তীতে আরো আলাপ করা যাবে।

মোহাম্মদ আরফার রাজী

ফুলব্রাইট ফেলো

কমিউনিটি এন্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং

ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস এট অস্টিন।

Shares:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *